Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://www.xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


মালঞ্চ - প্রথম অঙ্ক - দ্বিতীয় দৃশ্য, ১২
মালঞ্চ

নীরজা। কোনো খটকা থাকত না যদি তোমার সত্যিকার আগ্রহ থাকত।

আদিত্য। বিয়ে করবে অন্যপক্ষ, সত্যিকার আগ্রহটা থাকবে একা আমার, এটাতে কি কাজ চলে? তুমি চেষ্টা দেখো-না।

নীরজা। কিছুদিন গাছপালা থেকে ঐ মেয়েটার দৃষ্টিটাকে ছুটি দাও দেখি, ঠিক জায়গায় আপনি চোখ পড়বে।

আদিত্য। শুভদৃষ্টির আলোতে গাছপালা পাহাড়-পর্বত সমস্তই স্বচ্ছ হয়ে যায়। ও একজাতের এক‍্‍সরেজ আর-কি।

নীরজা। মিছে বক‍্ছ। আসল কথা, তোমার ইচ্ছে নয় বিয়েটা ঘটে।

আদিত্য। এতক্ষণে ধরেছ ঠিক। সরলা গেলে আমার বাগানের দশা কী হবে বলো। লাভলোকসানের কথাটাও ভাবতে হয়। ও কি ও, হঠাৎ তোমার বেদনাটা বেড়ে উঠল না কি?

নীরজা। (রুক্ষভাবে) কিছু হয় নি। আমার জন্যে তোমাকে তত ব্যস্ত হতে হবে না।

আদিত্য ওঠবার উপক্রম করছে

....আমাদের বিয়ের পরেই ঐ অর্কিড-ঘরের প্রথম পত্তন, ভুলে যাও নি তো সে কথা? তার পরে দিনে দিনে আমরা দুজনে মিলে ঐ ঘরটাকে সাজিয়ে তুলেছি। ওটাকে নষ্ট করতে দিতে তোমার মনে একটুও লাগে না?

আদিত্য। (বিস্মিতভাবে) সে কেমন কথা? নষ্ট হতে দেবার শখ আমার দেখলে কোথায়?

নীরজা। (উত্তেজিত হয়ে) সরলা কী জানে ফুলের বাগানের?

আদিত্য। বলো কী? সরলা জানে না? যে-মেসোমশায়ের ঘরে আমি মানুষ তিনি যে সরলার জ্যাঠামশায়। তুমি তো জানো তাঁরি বাগানে আমার হাতে-খড়ি। জ্যাঠামশায় বলতেন ফুলের বাগানের কাজ মেয়েদেরই, আর গোরু দোওয়ানো। তাঁর সব কাজে ও ছিল তাঁর সঙ্গিনী।

নীরজা। আর তুমি ছিলে সঙ্গী।

আদিত্য। ছিলেম বৈকি। কিন্তু আমাকে করতে হত কলেজের পড়া, ওর মতো অত সময় দিতে পারি নি। ওকে মেসোমশায় নিজে পড়াতেন।

নীরজা। সেই বাগান নিয়ে তোমার মেসোমশায়ের সর্বনাশ হয়ে গেল, এমনি ও মেয়ের পয়! আমার তো তাই ভয় করে। অলক্ষুণে মেয়ে। দেখো-না মাঠের মতো কপাল, ঘোড়ার মতো লাফিয়ে চলন। মেয়েমানুষের পুরুষালি বুদ্ধিটা ভালো নয়। ওতে অকল্যাণ ঘটায়।

আদিত্য। তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো নীরু? কী কথা বলছ? মেসোমশায় বাগান করতেই জানতেন, ব্যাবসা করতে জানতেন না। ফুলের চাষ করতে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়, নিজের লোকসান করতেও তাঁর সমকক্ষ কেহ ছিল না। সকলের কাছে তিনি নাম পেতেন, দাম পেতেন না। বাগান করবার জন্যে আমাদের যখন মূলধনের টাকা দিয়েছিলেন আমি কি জানতুম তখনি তাঁর তহবিল ডুবুডুবু। আমার একমাত্র সান্ত্বনা এই যে, তাঁর মরবার আগেই সমস্ত দিয়েছি শোধ করে।

সরলা কমলালেবুর রস নিয়ে এল

নীরজা। (সরলাকে) ঐখানে রেখে যাও।

রেখে সরলা চলে গেল